সোমবার, ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১:২৫ পূর্বাহ্ন

যে কারণে ১৫৬ ধরনের মিশ্র ওষুধ নিষিদ্ধ করলো ভারত

রিপোর্টারের নাম / ৩৪২ সময়
হালনাগাদ : সোমবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৪

১৫৬টি কম্বিনেশন’ ওষুধ নিষিদ্ধ করেছে ভারত সরকার। জ্বর, সর্দিকাশি, অ্যালার্জি, ত্বকের সংক্রমণ, পেট ব্যথাসহ একাধিক পরিচিত ওষুধের নাম রয়েছে সেই তালিকায়। এতে প্যারাসিটামল, সেট্রিজিন বা কিছু ভিটামিনের মতো নাম রয়েছে। তবে মূল ওষুধগুলো নিষিদ্ধ হয়নি, হয়েছে তাদের মিশ্রণ বা ককটেল ওষুধ।

এই জাতীয় ওষুধের প্রভাব মানুষের শরীরে কেমন, তা নিয়ে তর্কবিতর্ক বহু দিনের। এর আগেও এমন বহু মিশ্র ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এখন বেছে বেছে ১৫৬টির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কেন এমন ওষুধের বিক্রি বন্ধ হলো, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

চিকিৎসার ভাষায় এই ‘কম্বিনেশন’ ওষুধগুলোকে বলা হয় ‘এফডিসি’ অর্থাৎ, ‘ফিক্সড ডোজ কম্বিনেশন’। একাধিক ওষুধ বিভিন্ন মাত্রায় যোগ করে একটি ওষুধ তৈরি হয়। সহজ করে বললে, একাধিক রাসায়নিক গঠনযুক্ত ওষুধ। এসব ওষুধের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন আগেও উঠেছিল।

এই বিষয়ে মধ্য কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিউক্লিয়ার মেডিসিনের চিকিৎসক সোনালি ঘোষ বললেন, প্যারাসিটামলের সঙ্গে অ্যাসিক্লোফেন্যাক মিশিয়ে কম্বিনেশন করা হয়েছিল। এই ওষুধ দীর্ঘ দিন ধরে খেতে থাকলে লিভার ও কিডনির জটিল রোগ হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। এমন আরও অনেক অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক ওষুধ আছে, যাদের মিশ্রণ বাজারে চালু ছিল। ধরুন, যার জ্বর ও গায়ে ব্যথা রয়েছে, তাকে দুটি আলাদা ওষুধ না দিয়ে একটি কম্বিনেশন দেওয়া হলো। কিন্তু দুটি ওষুধ যে মাত্রায় মেশানো হয়েছে, তা সেই রোগীর শরীরের জন্য কার্যকরী না-ও হতে পারে। ওষুধটি খেতে শুরু করলে তার বিভিন্ন রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।

 

সোনালি বলছেন, সেট্রিজিন খেলে খুব ঘুম পায়। যথেষ্টই কড়া ওষুধ। এর সঙ্গে যদি অন্য অ্যান্টিবায়োটিকের মিশ্রণ করা হয়, তাহলে দুটি মিলে শরীরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতেই পারে। এখন রোগী যদি চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়েই তেমন ওষুধ কিনে খান, তাহলে অন্য জটিল রোগের আশঙ্কা বাড়বেই। তাই এমন ধরনের ওষুধ না খাওয়াই ভালো।

বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালের স্নায়ুরোগ চিকিৎসক অনিমেষ করের বক্তব্যও অনেকটাই এক। তার মতে, সুগার বা প্রেশারের ওষুধের মিশ্রণ তাও মানা যায়। কারণ দীর্ঘ সময় খেতে হয় এমন ওষুধ। যিনি চার থেকে পাঁচটি ওষুধ খান, তাকে একটি দিলে সুবিধাই হবে। কিন্তু কম সময়ে খাওয়ার অ্যান্টিবায়োটিক বা ব্যথানাশক ওষুধের যদি মিশ্রণ বানিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে সেগুলোর অনুপাত একটু এদিক-ওদিক হলেই শরীরে খারাপ প্রভাব পড়বে।

বছর কয়েক আগে এমন ওষুধ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যুগ্ম সংসদীয় কমিটি। ড্রাগ কন্ট্রোল কীভাবে সেগুলোকে অনুমোদন দিলো, কমিটি তার রিপোর্টও তলব করে। অনিমেষ বলছেন, এই ‘কম্বিনেশন’ ওষুধগুলো নিয়ে তেমন গবেষণা হয় না। একটি বা দুটি গবেষণাপত্রের ওপর ভিত্তি করে এমন ওষুধকে অনুমোদন দেওয়া ঠিক নয়। একটি ওষুধ হলে তার উপাদান, ট্রায়ালের ফল ও কার্যকারিতার বিস্তারিত রিপোর্ট থাকে। কিন্তু একাধিক ওষুধ মিলিয়ে যেটি তৈরি হচ্ছে, সেটির ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব কতটা, সে নিয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য থাকে না। এমন অনেক মিশ্র ওষুধ আছে যেটি অনুমোদন পাওয়ার ৬ মাসের মধ্যে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। কাজেই ভবিষ্যতে ‘কম্বিনেশন ড্রাগ’ বাজারে চালু করার আগে ভাবনাচিন্তা করে দেখা উচিত।

 

প্যারাসিটামল নিরাপদ ওষুধ। কিন্তু এর সঙ্গে যখন আইবুপ্রোফেন মিশছে, তখন সেটির প্রভাব কার শরীরে কেমন হবে, তা বলা সম্ভবই নয়। এমনটাই জানাচ্ছেন বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালের স্ত্রীরোগ চিকিৎসক মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায়। তার বক্তব্য, ইংল্যান্ড, আমেরিকায় ককটেল বা মিশ্র ওষুধের চল নেই। সেখানে প্যারাসিটামল বলতে প্যারাসিটামলকেই বোঝায়। তার সঙ্গে আরও চারটি অ্যান্টিবায়োটিকজুড়ে দিয়ে ওষুধ তৈরি হয় না। আমাদের দেশে বিভিন্ন সংস্থা তাদের মতো অনুপাতে একাধিক রাসায়নিক গঠনের ওষুধ মেশাচ্ছে। তাই সেগুলো কতটা নিরাপদ, তা যাচাই করা সম্ভবই নয়। রোগী তো আরও বুঝতে পারবেন না।

সব ককটেল ওষুধ মন্দ নয়, কিন্তু যেগুলোর গবেষণাই হয়নি, সেগুলি পুরোপুরি বেআইনি, এমনটাই জানালেন বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালের সিনিয়র কার্ডিয়োলজিস্ট দিলীপ কুমার। তার মতে, একে বলা হয় ফাইটোডায়ানামিক্স। ওষুধের রাসায়নিক গঠন, কোন উপাদানের কী কার্যকারিতা তা জানতে হয় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। হাইপারটেনশনের এমন অনেক ওষুধ আছে যেগুলোর মিশ্রণ করলেই রোগীর সুবিধা হয়। খরচও কম হয়। অর্থাৎ, চারটে ওষুধ না কিনে একটি কিনতে হয়। কিন্তু সেই ওষুধ গবেষণা দ্বারা প্রামণিত ও কেন্দ্রীয় ড্রাগ নিয়ামক সংস্থার অনুমোদন প্রাপ্ত।

দিলীপ কুমারের বক্তব্য, এমন অনেক ‘কম্বিনেশন’ ওষুধ আছে, যেগুলোর উপাদান ও অনুপাত ওষুধ নির্মাতা সংস্থাগুলো নির্ধারণ করে। তাই তেমন ওষুধ খেলে রোগীর শরীরে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।

 

‘ককটেল’ বা মিশ্র ওষুধ নিজে থেকে চেনার উপায় নেই। কারণ ওষুধের পাতায় তা লেখা থাকে না। একমাত্র চিকিৎসকই তা প্রেসক্রাইব করতে পারেন। তবে বিভিন্ন ভুয়া সংস্থা বা ওষুধের দোকান এই জাতীয় ওষুধ অনুমোদন ছাড়াই বিক্রি করছে কি না, তা-ও চিন্তার বিষয়। সে কারণেই কেন্দ্রীয় সরকার উদ্যোগী হয়ে তেমন কিছু ওষুধের উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর
এক ক্লিকে বিভাগের খবর